পৃথিবীর সকল জাতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রত্যেক জাতি বা জনগোষ্ঠীর পৃথক বংশ পরিচয়-ইতিহাস রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩ টি উপজাতির জীবন যাত্রা স্বতন্ত্র, বৈচিত্রময় কিন্তু সহজ সরল। এই নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা পর্যায়ক্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ।
ক) চাকমা: দ্বাদশ শতাব্দীতে প্রথম ‘‘চাগমা’’ শব্দের অস্তিত্ত্ব এবং ষোড়শ শতাব্দীতে এ অঞ্চলে এ নামের একটি জনগোষ্ঠীর বসবাসের তথ্য পাওয়া যায়। এই ‘‘চাগমা’’ জাতিগোষ্ঠী শাব্দিক বা উচ্চারণগত দিক থেকে যাই হোক না কেন এরাই যে বর্তমানে ‘‘চাকমা’’ নামে পরিচিত জনগোষ্ঠী তাতে কোন সন্দেহ নেই। চাকমারা মূলত: বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং ‘‘বিজু’’ তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব। চাকমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী ‘‘জুম নৃত্য’’ দেশে-বিদেশে দারুণভাবে প্রশংসিত। তুলনামূলকভাবে চাকমারা অধিক শিক্ষিত। তবে চাকমা উপজাতীয় রমণীরা অত্যন্ত কর্মঠ ও পরিশ্রমী। চাকমাদের মধ্যে প্রচলিত কথ্য ভাষার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে ষ্পষ্টত: প্রমাণিত হয় যে, তা বাংলা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষারই অপভ্রংশ। চাকমারা চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার অপভ্রংশের মতো উচ্চারণ রীতি ব্যবহার করলেও চাকমা ভাষার বর্ণমালা বর্মী আদলে তৈরি। ব্রিটিশ আমলে কর্মরত চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মিঃ জিন বিসম ০৫ অক্টোবর ১৮৭৯ সালে রাজস্ব বোর্ডের নিকট লিখিত পত্রে উল্লেখ করেন, ‘‘ চাকমাগণ অর্ধ বাঙ্গালী। বস্ত্তত ইহাদের পোশাক পরিচ্ছদ এবং ইহাদের ভাষাও বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ মাত্র। এতদ্ভিন্ন চাকমাদের উপাধি ভিন্ন নামগুলোও এমন বাঙালী ভাবাপন্ন যে, তাহাদিগকে বাঙালী হইতে পৃথক করা একরূপ অসম্ভব’’।
খ) মারমা:পার্বত্য জেলাসমূহে মারমারা সংখ্যায় দ্বিতীয় হলেও খাগড়াছড়িতে এরা তৃতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ উপজাতি। বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি জেলাতেই মূলত: এদের বসবাস। মারমারা অত্যন্ত অতিথিপরায়ন। এ জনগোষ্ঠীর মেয়েরা অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন। তারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এবং তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘‘সাংগ্রাইং’’। সাধারণত: মারমা বর্ষপঞ্জি ঘোষণাপত্র ‘‘সাংগ্রাইংজা’’ এর মাধ্যমে চান্দ্রমাস অনুসারে মারমারা তাদের প্রধান সামাজিক উৎসব ‘‘সাংগ্রাইং’’ পালন করে থাকে। বহু পূর্বে মারমারা ‘‘মগ’’ নামেই পরিচিতি ছিল। বর্তমানে তারা নিজেদের ‘‘মারমা’’ বলেই দাবি করে। ‘‘মারমা’’ শব্দটি ‘‘মারমাজা’’ বা ‘‘ম্রাইমাচা’’ নামক উপমহাদেশীয় প্রাচীন ব্রাহ্মী হস্তাক্ষর লিপি থেকে উদ্ভুত। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সরকারিভাবে মারমা জনগোষ্ঠী স্বতন্ত্র উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
মারমা ভাষার নিজস্ব হরফও আছে। এ বর্ণমালা ‘‘মারমাচা’’ বা ‘‘ম্রাইমাজাহ্’’ নামে পরিচিত। ১৩ টি স্বরবর্ণ ও ৩৬ টি ব্যঞ্জনবর্ণ নিয়ে প্রণীত মারমা বর্ণমালা প্রাচীন ভারতের ব্রহ্মী ও খরেষ্ট্রী লিপি হতে উদ্ভুত। মারমারা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হলেও তারা অন্যান্য উপজাতীয়দের ন্যায় দেবতা ও অপদেবতায় বিশ্বাসী। তবে বৌদ্ধ ধর্মের অন্যান্য উৎসব পার্বণাদিও তারা পালন করে। মারমা জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী থালা নৃত্য, প্রদীপ নৃত্য, পরী নৃত্য অত্যন্ত আকর্ষণীয়।
গ) ত্রিপুরা:পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত আদিবাসীদের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে ত্রিপুরারাই ইতিহাস সমৃদ্ধ জাতি। খ্রিষ্স্টাব্দ গণনার বহু পূর্ব হতেই এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের অস্তিত্ত্ব ছিল। মহাভারতে বর্ণিত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধেও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অংশ নিয়েছিল বলে জানা যায়। ৫৯০ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজা যুঝারুফা কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের পর স্মারক হিসেবে ‘‘ত্রিপুরাব্দ’’ প্রবর্তনের পর হতে ত্রিপুরাদের লিখিত ইতিহাসের সূচনা ঘটে। সঠিক তথ্য জানা না গেলেও বহু আদিকাল থেকে এ অঞ্চলে ত্রিপুরাদের বসবাস ছিল। অধ্যাপক শাহেদ আলী তাঁর ‘‘ বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান’’ বইয়ে লিখেছেন - পাহাড়ী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরারাই সবচেয়ে সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী। ত্রিপুরারা সনাতন ধর্মাবলম্বী। তাদের প্রধান উপজীবিকা কৃষি তথা জুমচাষ। তাদের প্রধান উৎসব ‘‘বৈসাবী’’। উপজাতি প্রায় সকল রমণীরাই নিজেদের তৈরি তাঁতে বোনা কাপড় পড়ে। এদের পরনের কাপড়কে ‘‘রিনাই’’, ‘‘রিসাই’’ বলে। রূপার তৈরি অলংকার ত্রিপুরা রমণীদের খুব প্রিয়। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী ‘‘গড়াইয়া’’ ও ‘‘বোতল নৃত্য’’ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। ত্রিপুরাদের মধ্যে ‘‘রোয়াজা’’ উপাধি ধারীরাই সামাজিক বিচার আচার করে থাকে।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS